মনিরুলের অবৈধ সম্পদের পাহাড়, চালাতেন জঙ্গিবাদে অর্থদাতা নিষিদ্ধ এনজিও
মনিরুল ইসলাম। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ এসবি’র সাবেক প্রধান। এক সময়ের প্রবল প্রতাপশালী এই অতিরিক্ত আইজিপি’র অনিয়মের শেষ নেই। ডিএমপি’র যুগ্ম কমিশনার থেকে এসবি প্রধান।
গত ১০ বছরে নাটকীয় উত্থান। অল্প সময়ে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। ক্রসফায়ারের হুমকি, তুলে নিয়ে ডিবি দিয়ে নির্যাতন, বিঘায় বিঘায় জমি দখল, বাড়ি দখল, ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে কোটি টাকা আদায়, মামলা বাণিজ্য, জঙ্গি নাটক সাজিয়ে মালিককে গ্রেপ্তার করে এনজিও ছিনতাই, শ্যালককে দিয়ে পিডব্লিউডির টেন্ডারবাজি এমন কোনো কাজ নেই, যা করেনি এই মনিরুল। জঙ্গি দমনে কাজ করা এই মনিরুল নিজেই জঙ্গিবাদে অর্থদাতা হিসেবে পৃথিবীজুড়ে নিষিদ্ধ দুটি এনজিও পরিচালনায় জড়িত ছিলেন।
রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা ও পুনর্বাসনের নামে ৭ বছরে এই এনজিও মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা অনুদান এনেছে। নানা অনিয়ম, দুর্নীতিতে জড়ানো এই পুলিশ কর্মকর্তা শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরে গা ঢাকা দিয়েছেন।
যেভাবে নিষিদ্ধ এনজিওর দখল করেন মনিরুল: মনিরুল ইসলাম বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক দুটি এনজিওর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সূত্র বলছে, ১৯৯৪ সালে কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি নামে একটি এনজিও বাংলাদেশে তাদের প্রথম কার্যক্রম শুরু করেন।
এটি পরিচালনা করতেন একটি প্রভাবশালী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের দ্বিতীয়সারির নেতা মো. জামাল আব্দুল খালেক আল নুরী। প্রথমদিকে এনজিওটি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা নির্মাণ ও ছিন্নমূল বয়স্ক মানুষের পুনর্বাসনের কাজ করতো। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬ সালে মনিরুল ইসলাম জঙ্গি দমনে গঠিত কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান হয়েই কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি নামে এনজিওটির চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করেন। পরে এনজিওটি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। নাম সংস্কার করে কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ নাম দেন।
এরপর দখল করেন শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল নামের আরেকটি এনজিও। জাতীয় এনজিও ব্যুরোর নথি বলছে, ২০১৭ সালে নভেম্বর মাসের ২ তারিখে কুয়েত জয়েন্ট কমিটি এনজিওটির নাম পরিবর্তন করা হয়। যাতে মনিরুল ইসলাম সুপারিশ করেন। এরপর থেকেই এনজিও দুটি ভিন্ন নামে ভিন্ন রূপে নির্বিঘ্নে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যার নেপথ্যে ছিলেন এসবি সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম। তার প্রভাবে এই এনজিও কার্যক্রম নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলার সাহস পাননি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, জঙ্গিবাদে অর্থদাতা হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক এনজিও দুটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। বাংলাদেশেও এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি ২০১৭ সালে জঙ্গি সংগঠনগুলোর অর্থ জোগানদাতা হিসেবে চিহ্নিত ১৭টি এনজিওর তালিকা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই তালিকায় মনিরুল ইসলামের দখল করা এনজিও দুটির নামও ছিল। পরে নাম কিছুটা সংস্কার করে প্রভাব খাটিয়ে ওই তালিকা দেখে এনজিও দুটি দেন মনিরুল ইসলাম। গোপনে তিনি ওই এনজিওর মাধ্যমে কুয়েত থেকে অর্থ সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যান। তবে ২০১৭ সালে রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি টের পেয়ে গেলে তিনি কৌশলে ওই এনজিওর মালিকানা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন। পরে ২০১৮ সালে ২০শে জুন এনজিওটির চেয়ারম্যান বানানো হয় মনিরুল ইসলামের শ্যালক রেজাউল আলম শাহীনকে। অনুসন্ধান বলছে, দুটি এনজিও গত ৭ বছরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের নামে মধ্যপ্রাচ্য থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা অনুদান সংগ্রহ করে। যার নেপথ্যে ছিলেন মনিরুল ইসলাম নিজেই। বর্তমানে এনজিওটির নামমাত্র প্রধান গাজী জহিরুল ইসলাম। কিন্তু নাম থাকলেও এটি পরিচালনা করেন রেজাউল আলম শাহীন নিজেই।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কেএসআর কুয়েত ভিত্তিক একটি খাদ্য বিতরণ এনজিও। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা হওয়া এনজিওটির পূর্ব নাম ছিল রিভাইভাল অব দ্য ইসলামিক হেরিটেজ। নাইন ইলেভেনে যুক্তরাষ্ট্রের টু-ইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে এনজিওটির বিরুদ্ধে। এজন্য ২০০৩ সাল থেকে বিশ্বের অনেক দেশে এনজিওটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ ও শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল নামে দুটি এনজিও যত নির্মাণ কাজ করেছে তার পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করেছে রেজাউল হক শাহীনেরই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসএস এন্টারপ্রাইজ। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অবকাঠামো নির্মাণ কাজে সহায়তা প্রদান করেছে। এর মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকা অর্থ লোপাটের অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুয়েতভিত্তিক নিষিদ্ধ কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ এবং শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনালের অনুদানের পুরোটাই মনিরুলের সহায়তায় লুটপাট করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক এসবি প্রধান মনিরুলের দাপটে এই এনজিওর আয়-ব্যয় ও অফ চ্যানেলে অস্বাভাবিক অর্থ লেনদেনের কোনো ফাইল আটকাতে পারেনি এনজিও বিষয়ক ব্যুরো, সমাজসেবা অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও গোয়েন্দা সংস্থা। সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের উচ্চ মহলে এই এনজিও দুটির আর্থিক লেনদেনে অসামঞ্জস্যতা ও পুনর্বাসন প্রকল্পে দুর্নীতির প্রতিবেদন দিলেও মনিরুলের দাপটে তা আটকে যায়। ওই গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটির (কেজেআরসি)’র আর্থিক সন্দেহজনক লেনদেন ও প্রকল্পে অনিয়মের জন্য এনজিওটি বন্ধের সুপারিশ করলে তখন মনিরুলের প্রভাবে আটকে যায়। কুয়েত সোসাইটি ফর রিফিল (কেএসআর) যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ০৬৫১ এবং শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল, রেজিস্ট্রেশন নম্বর ০৮২৫। দুটি এনজিও-ই হাউস-০২, রোড ০৬/এ, সেক্টর-০৪, উত্তরা, ঢাকা: ১২৩০ ঠিকানা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা। এনজিও দুটির পরিচালনায় অন্য ব্যক্তিরা থাকলেও সরকারি নথি ও দাপ্তরিক কার্যাবলিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে মনিরুলের শ্যালক শাহীনের নামই ব্যবহার করা হয়েছে।
মনিরুলের যত হোটেল রিসোর্ট:
পুলিশের চাকরিতে থেকেই গত এক দশকে প্রভাব খাটিয়ে কয়েক একর জমি দখল করে হোটেল ও রিসোর্ট করেছেন মনিরুল ইসলাম। তবে সরাসরি নিজের নামে না করে তা শ্যালক রেজাউল আলম শাহীনের নাম ব্যবহার করেছেন। ২০১৭ সালে কক্সবাজারের ডলফিন মোড়ে একটি ৫ তারকা হোটেল করেন মনিরুল। নাম ‘হোটেল দ্য আলম’। হোটেলটি ১২ তলা বিশিষ্ট। যা সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন। বিলাসবহুল এই পাঁচ তারকা হোটেলের মালিক মনিরুলের শ্যালক রেজাউল আলম শাহীন। এ ছাড়া ফরিদপুর শহরের চরকমলাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে মনিরুল ইসলামের নামে ১৫ কাঠার একটি প্লট আছে। সম্প্রতি ওই প্লটে একটি বাংলো বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সাভারের ধউর ব্রিজ পার হয়ে (জিরাবোর দিকে যেতে) হাতের ডান দিকে রাস্তা ঘেঁষা কয়েক একর জমি আছে মনিরুল ইসলাম, শ্যালক রেজাউল ও স্ত্রী শায়লা ফারজানার নামে। যার অধিকাংশ দখল করা। মনিরুলের ভয়ে জমির মালিকরা প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারেনি। এ ছাড়া গাজীপুরে মনিরুলের শ্যালক শাহীন ও গাজী জহিরুল আলমের নামে এক দাগে ৪ একর জমি কিনেছেন মনিরুল ইসলাম। ওই জমির দখল নিয়ে বিরোধ চলছে। এদিকে ২০১৭ সালে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান বাহেরকুচিতে ঢালিস আম্বার রিসোর্টের পাশে প্রায় ১৫ একর জমি কেনেন মনিরুল ইসলামের স্ত্রী শায়লা ফারজানা। শায়লা ফারজানা তখন মুন্সীগঞ্জের ডিসি ছিলেন। তিনি থাকা অবস্থায় এই জমি ক্রয় করা হয়। বর্তমানে এই জমিতে একটি মিনি রিসোর্টের নির্মাণ কাজ চলমান আছে। একটি সূত্র বলছে, ডিসি থাকা অবস্থায় পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প, রেললাইন, ফেরি ঘাট স্থানান্তরিত করতে শত শত একর জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। তখন ভূমি অধিগ্রহণে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়ম করে শত কোটি টাকা আয় করেন তৎকালীন মুন্সীগঞ্জের সাবেক ডিসি শায়লা ফারজানা। ওই টাকা দিয়েই বাহেরকুচি ইছাপুরা এলাকায় এই জমি ক্রয় করেন মনিরুল দম্পতি।
সাংবাদিক নির্যাতনে ভয়ঙ্কর মনিরুল:
২০২১ সালের ৩১শে মে রাতে মনিরুল ইসলামের নির্দেশে সাবেক ডিসি কাজী শফিকুল আলম সাংবাদিক নুজহাতুল হাচানকে চোখ বেঁধে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। ডিবিতে ৫দিন আটকে রেখে ক্রসফয়ার দিতে উদ্যোগ নেয়া হয়। পরে পলাতক দেখিয়ে ২টি মামলা দেয়া হয়। ৫ বছর মনিরুলের রোষানলে পড়ে পুলিশের হয়রানি, মামলা ও মারধরের শিকার হয়ে পালিয়ে বেড়ান এই সাংবাদিক। নুজহাত ওই সময়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে মনিরুলের স্ত্রী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব সায়লা ফারজানা ওই টেলিভিশনে ফোন করে নুজহাতকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য করেন। জোরপূর্বক এই সাংবাদিকের সম্পাদনার একটি পত্রিকা অফিস ভেঙে দেয়া হয়। ডিবি পুলিশ দিয়ে অফিসে তালা মেরে দেয়া হয়। পুলিশ ওই পত্রিকা অফিসের কম্পিউটার ও গুরুত্ব্বপূর্ণ কাগজপত্র নিয়ে যায়। এ বিষয়ে সাংবাদিক নুজহাতুল হাচান মানবজমিনকে বলেন, ২০২১ সাল থেকে ২৩ সাল পর্যন্ত আমার ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন করেন মনিরুল। আমাকে ডিবিতে তুলে নিয়ে চোখ বেঁধে পেটানো হয়। ৫দিন আমাকে পিটিয়ে প্রায় পঙ্গু করে দেয়া হয়। ২০২১ সালের ৪ঠা জুন মনিরুলের নির্দেশে আমার স্ত্রীকে ডিবিতে ডেকে নিয়ে তাদের কিছু শর্ত মেনে নিলে আমাকে ছেড়ে দেয়া হবে বলা হয়। প্রথমত, আমি আর সাংবাদিকতা করতে পারবো না, আমি পত্রিকা চালাতে পারবো না, আমার নির্যাতন নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে পারবো না। ঢাকায় থাকতে পারবো না, গ্রামে চলে যেতে হবে। তখন আমার স্ত্রী আমাকে বাঁচাতে নিরুপায় হয়ে সকল শর্ত মেনে নেয়। পরে ডিবি অফিসে স্ট্যাম্পে লিখিত রেখে মুচলেকা দিয়ে আমাকে ছেড়ে দেয়। তাদের শর্তগুলো না মানলে ভবিষ্যতে আমার নামে মামলা হবে এবং ডিবিতে ধরে এনে শেষ করে দিবে হুমকি দেন। আমি ২০২১ থেকে ২০২২ পর্যন্ত গ্রামে মনিরুলের বিশেষ নজরদারিতে গৃহবন্দি অবস্থায় থাকি। বাড়ি থেকে বের হতে পারতাম না। জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যেতে পারতাম না। প্রায়ই বাড়িতে পুলিশ পাঠানো হতো। মনিরুল ইসলাম অতিরিক্ত আইজিপি হওয়ার পর আমাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পুরাতন দুটি মামলায় পলাতক দেখিয়ে, আদালতে চার্জশিট দিয়ে ওয়ারেন্ট জারি করে ডিবি উত্তর। আমি তখন জামিন চেয়ে কোর্টে সারেন্ডার করি। আদালত জামিন না দিয়ে আমাকে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেয়। প্রায় ২৫ দিন জেল খেটে জামিনে মুক্তি পাই। অত্যাচার সইতে না পেরে জীবন বাঁচাতে ২০২৩ সালে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। পরে রাশিয়ার ভিসা নিয়ে বিদেশে যেতে গেলে আমাকে এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনে আটকে দেয়া হয়। তখন আমার পাসপোর্ট জব্ধ করান মনিরুল। দেয়া হয় একাধিক মামলা।
শ্যালকের নামে কেনা মনিরুলের যত সম্পদ:
রেজাউল আলম শাহীন মনিরুল ইসলামের শ্যালক এবং সম্প্রতি ওএসডি হওয়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সায়লা ফারজানা শিউলির ছোট ভাই। সদ্য সাবেক গাজীপুরের এসপি কাজী সফিকুল আলমের শ্যালক। মনিরুলের দেশে যে সকল অবৈধ সম্পদ রয়েছে তার অধিকাংশই তার বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের নামে। তবে এদের মধ্যে তার বিশ্বস্ত শ্যালক শাহীন ও তার স্ত্রী সানজিদা বেগম ওরফে তানজিন টুম্পার নামে অনেক সম্পদই কিনেছেন মনিরুল। এর ফলে রাতারাতি হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন শাহীন। অথচ ২০১৮ সালেও তিনি ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বরে একটি ছোট বাসায় ভাড়া থাকতেন।
বেনামে মনিরুলের যত বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট: ক্ষমতার দাপট খাটিয়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন মনিরুল-সায়লা দম্পতি। ভাই, বোন, শ্যালকের নামে এসব সম্পদ করে নিজেদের আড়ালে রেখেছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫৫/১ বেইলি রোডে রূপায়ন স্বপ্ন নিলয় টাওয়ারে মনিরুলের ৪৮০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া মিরপুরের বিজয় রাকিন সিটিতে ৩৮০০ স্কয়ার ফিটের আরও একটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। যেখানে মনিরুল ইসলামের শ্যালক রেজাউল শাহীন পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। মিরপুর পুলিশ কলেজের পাশে পুলিশ কনভেনশন সংলগ্ন ২.৫ কাঠার প্লটে ১০ তলা বাড়ি। মিরপুর ডিওএইচএস সংলগ্ন ৬ কাঠার প্লট। উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরে ৬ কাঠার ৪টি প্লট রয়েছে মনিরুলের যার ২টি শাহিন ও তার স্ত্রীর। রাজধানীর মিরপুর, উত্তরাতে ৫৫টি ফ্ল্যাট কিনেছেন মনিরুল যা তার শ্যালক শাহীন ও তার স্ত্রীর নামে রয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, মিরপুর ১০ নম্বরে একাধিক বাড়ি রয়েছে মনিরুলের।
মনিরুলের যত দখল: গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে মনিরুলের বিশাল একটি বাগান বাড়ি রয়েছে। যার মূল্য ৫ কোটি টাকার বেশি হবে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া মুকসুদপুর বাটিকামারী ডিগ্রি কলেজের পেছনে ৫৬ শতাংশ জমি জোরপূর্বক দখলে নেন মনিরুল ইসলাম। পুলিশি চাপে পড়ে নামমাত্র দামে ওই জমি কিনে নেন মনিরুল ইসলাম। এ ছাড়া নিজ গ্রাম বাহাড়া এলাকায়ও মনিরুলের বিরুদ্ধে বিঘায় বিঘায় জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। গোপালগঞ্জ ও গাজীপুরে মনিরুলের মাছের দুটি ঘের রয়েছে বলেও তার একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে জানা গেছে।
বিদেশে ছেলের নামে ব্যবসা:
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মনিরুলের লন্ডনের বিভিন্ন এলাকায় বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। মনিরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সিলেটের সদ্য সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার লন্ডনে বড় ব্যবসায়ী। এই আনোয়ারের ব্যবসায় মনিরুলের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে বলে জানা গেছে। মনিরুলের একমাত্র ছেলে অনন্য ইসলামও লন্ডনে থাকেন। ছেলেই ওই ব্যবসা ও সম্পদের দেখভাল করেন। এ ছাড়া কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনের মিরপুর শাখায় মনিরুল ইসলাম, সায়লা ফারজানা ও শ্যালক শাহীনের গোপন বেশ কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। যে অ্যাকাউন্টগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে বলে ওই ব্যাংকের একটি সূত্র মানবজমিনকে নিশ্চিত করেছেন।
প্রভাব খাটিয়ে দখল ও টেন্ডারবাজি
পিডব্লিউডিতে টেন্ডার বাণিজ্যে বেপরোয়া ছিলেন মনিরুলের শ্যালক রেজাউল আলম শাহীন। পিডব্লিউডি’র টেন্ডারে ছিল তার একচ্ছত্র আধিপত্য। দুলাভাই মনিরুল, বোন সায়লা ফারজানা ও আরেক দুলাভাই এসপি কাজী সফিকের ক্ষমতার দাপটে পিডব্লিউডিতে টেন্ডার বাণিজ্যে বেপরোয়া হয়ে উঠেন শাহীন। ঠিকাদারদের একটা সিন্ডিকেটকে পুরো নিয়ন্ত্রণ করতেন শাহীন। এসএস এন্টারপ্রাইজের নামে কোটি কোটি টাকার টেন্ডার বাগিয়ে নিয়েছেন তিনি। এমনকি টেন্ডার পাইয়ে দিতে নিতেন মোটা অঙ্কের কমিশন। মনিরুলের আরেক শ্যালক বুলবুল আহমেদ মামুন ঢাকার গণপরিবহনের অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন। তিনি ঠিকানা পরিবহন, বসন্ত পরিবহনসহ বেশ কয়েকটি পরিবহনের মালিক ছিলেন। পরিবহন ব্যবসা থেকে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি করেছেন এই মামুন। যা থেকে একটি অংশ সরাসরি মনিরুলের পকেটে চলে যেত। মামুন ঢাকার রাকিন সিটিতে ১৮০০ স্কয়ার ফিটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকেন। মিরপুরে তিনিও কিনেছেন বাড়ি। কাজী সফিকুল আলম মনিরুলের ভায়রা। তিনি গাজীপুরে ডিবির পুলিশ সুপার (এসপি) ছিলেন।
অর্থের বিনিময়ে জমি দখল করে দেয়া, বালু ব্যবসা, পোস্টিং বাণিজ্য, মাদক ব্যবসায়ীদের আশকরা দেয়া, ওসির কাছ থেকে ঘুষ নেয়া এবং ঝুট ব্যবসাসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গাজীপুরের এসপি হিসেবে যোগদানের মাস দেড়েকের মধ্যেই কালীগঞ্জের নাগরী ইউনিয়নের উলুখোলা এলাকায় সাড়ে তিন কোটি টাকা দিয়ে জমি কেনেন শফিকুল। ডিবিতে থাকাকালীন সময়ে উত্তরাতে ৬ কাঠার একটি প্লট কিনেন। উত্তরাতে ৪টি ফ্লাট রয়েছে কাজী সফিকের। এ ছাড়াও মিরপুর, বনশ্রীতে তার আরও ৫টি ফ্ল্যাট রয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামের মুঠোফোনে কল দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে খুদে বার্তা দিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি।
সূত্র: মানবজমিন